আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং করণীয়
শামসুল আলম
চেয়ারম্যান, এডুকেশন রিসার্চ ফাউন্ডেশন (ই,আর,এফ)
প্রাগৈতিহাসিক কালে শিক্ষা শুরু হয়েছিল বয়স্ক ব্যক্তিদের দ্বারা যুবকদের সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতার প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে। প্রাক-শিক্ষিত
সমাজ মূলত মৌখিকভাবে এবং অনুকরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। গল্প বলার মাধ্যমে জ্ঞান, মূল্যবোধ এবং দক্ষতা এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মের
কাছে স্থানান্তরিত হয়েছে।
আমাদের রয়েছে শিক্ষার একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস। সেই প্রাচীন ভারতবর্ষে ছিল সার্বজনীন শিক্ষার অবারিত দ্বার। শিক্ষাব্যবস্থা ছিল টোল এবং পাঠশালা
কেন্দ্রিক। উপজাতি এবং শূদ্র ছাড়া সকলেই সেই শিক্ষা লাভের সুযোগ পেত। পাঠশালায় গণনা এবং পৌরাণিক কাহিনী পড়ানো হতো। প্রাচীন ভারতবর্ষে
এমনকি প্রাক বৃটিশ আমলেও আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল ধর্মকেন্দ্রিক। তবে সেখানে চিকিৎসা, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং যুদ্ধবিদ্যাসহ অন্যান্য শিক্ষাও
প্রদান করা হতো।
প্রাচীন ভারতের সর্বপ্রথম শিক্ষা ব্যবস্থা হলো বৈদিক শিক্ষা। ‘বেদ’ প্রাচীন ভারতে লিপিবদ্ধ একটি বৃহদাকার গ্রন্থ সংকলন যাতে রয়েছে বিভিন্নরকম
তত্ত¡জ্ঞান। বেদই ছিল বৈদিক শিক্ষার মূল উৎস। বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠদান ছিল গুরুকেন্দ্রিক এবং গুরু শ্রæতি পদ্ধতিতে শিষ্যদের পাঠদান করতেন।
অর্থাৎ শুনে শুনে শিক্ষা লাভ করতে হতো শিক্ষার্থীদের। অগ্রবর্তী শিক্ষার্থীদের ওপর দায়িত্ব থাকতো বাকিদেরকে শিক্ষাদানের এবং এই পদ্ধতিকে বলা হতো
‘সরদার পড়ো’। পরিপূর্ণভাবে বেদ শিখনের জন্য একজন শিষ্যকে টানা বারো বছর গুরুগৃহে অবস্থান করতে হতো। এ শিখন-শেখানো প্রক্রিয়াকে অত্যন্ত
পবিত্র জ্ঞান করা হতো। কারণ সে সময় পার্থিব জীবনের তুলনায় আধ্যাত্মিকতা অধিক গুরুত্ব দেওয়া হতো।
বৈদিক শিক্ষা ব্যবস্থার পরবর্তী সময়ে বৌদ্ধ ধর্ম বিশ্বাস বা বৌদ্ধ মতামতের আলোকে বৌদ্ধ বিহারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা।
বৌদ্ধরাই এ দেশে সর্বপ্রথম বিহার এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থীকে তার শিক্ষা অর্জনের পুরো সময়টিতেই
বিহারে অবস্থান করতে হতো। বৌদ্ধ আমলে এখানে বেশ কিছু বিহার গড়ে উঠেছিল। মুসলমানদের আগমনের ফলে এখানে শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল
পরিবর্তন ঘটে। ভারতবর্ষের অধিবাসীগণ তখন পারস্য এবং আরবীয় সভ্যতার সংস্পর্শে আসার সুযোগ পায়।
এদেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থার উপর প্রথমে কুঠারাঘাত করেন বৃটিশ শাসকগণ। দেশীয় শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে তারা ছিলেন সম্পূর্ণ অজ্ঞ ও উদাসীন। তারা দেশীয়
শিক্ষাকে অপ্রয়োজনীয় এবং মূল্যহীন মনে করতেন। তারা চেষ্টা করতেন দেশীয় শিক্ষাকে কীভাবে এদেশের মাটি থেকে মুছে ফেলে তথাকথিত আধুনিক
শিক্ষার নামে ইংরেজি শিক্ষাকে এদেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া যায়। লর্ড মেকলের মতে, এ দেশে এমন এক শ্রেণির লোক গড়তে হবে যারা
আমাদের দোভাষীর কাজ করবে। তারা হবে এমন এক শ্রেণির লোক যারা রক্তের বর্ণে ভারতীয় কিন্তু রুচি, নীতি ও বুদ্ধিতে ইংরেজ।
স্বাধীনতা পূর্ববর্তী এবং স্বাধীনতা উত্তরকালে, এমনকি বৃটিশ আমলে অনেকগুলো শিক্ষা কমিশন গঠিত হলেও কোনো শিক্ষা কমিশনই পরিপূর্ণ আলোর মুখ
দেখেনি। ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে বৃটিশ ভারতে প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়; যেটি হান্টার কমিশন নামে পরিচিত। হান্টার কমিশনের উল্লেখযোগ্য দিক ছিল যে,
এই কমিশনই সর্বপ্রথম প্রাথমিক শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় কর্তব্য বলে বর্ণনা করেন এবং এর ভবিষ্যৎ উন্নয়নের পথ সুপ্রশস্ত করেন। পরবর্তীতে লর্ড কার্জন,
স্যাডলার কমিশন, সার্জেন্ট কমিশন এদেশের শিক্ষার সংস্কার এবং বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্মের পর ঐ বছরের ২৭ শে নভেম্বর থেকে পাঁচদিন করাচিতে পাকিস্তানের প্রথম শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সম্মেলনে পাকিস্তানে শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ড গঠনসহ পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলামী আদর্শে গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করে স্কুল পার্যায়ে
বাধ্যতামূলকভাবে উর্দুপড়া, স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা, শিক্ষা গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন, কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয় স্থরে সামরিক
প্রশিক্ষণ, আন্তঃ বিদ্যালয় বোর্ড গঠন, কারিগরি শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠা ও নারী শিক্ষার সম্প্রসারণ প্রভৃতি প্রস্তাব গ্রহণ করে। পাকিস্তান আমলে আরও তিনটি
শিক্ষা কমিশনÑ মাওলানা মুহাম্মদ আকরাম খান শিক্ষা কমিশন, আতাউর রহমান খান শিক্ষা কমিশন এবং শরীফ ও হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন গঠিত
হয়। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতার পর প্রথম গঠিত হয় কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন। কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে ১৮ জন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদের
সমন্বয়ে এ কমিশন গঠন করা হয়। এরপর ১৯৭৯ সালে অন্তবর্তীকালীন শিক্ষা কমিশন, ১৯৮৮ সালে মফিজ উদ্দিন শিক্ষা কমিশন, ১৯৯৭ সালে জাতীয়
শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি এবং ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষা নীতি গঠন করা হয়।
তবে বাংলা দেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় সবেচেয় বড় আঘাত আসে ২০২৩ সালে। এর আগেই ত্রæটিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আমরা কথা বলে আসছি। কÑএ
কুকুর, খÑএ খরগোশ, গ-এ গরু; আর ঘ-এ বাঘ শৈশবেই শিশুদের ফুল, পাখি, নদী, প্রজাপতি, উদার আকাশ, সবুজ মাঠ এর সাথে পরিচয় না ঘটিয়ে
তাদেরকে হি¯্র জন্তু জানোয়ারের সাথে পরিচিত হতে বাধ্য করছি। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সে হাতে ফুল না নিয়ে অস্ত্র তুলে নিলে বিস্মিত হবার কিছু
নেই। শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং দেশে প্রেমের শিক্ষা না থাকলে সে চাকরি করতে এসে দেশ সেবার পরিবর্তে অচিরেই একজন ভয়ংকর রকমের ঘুষঘোর এবং দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে এটাই স্বাভাবিক। তাকে শৈশবে শিক্ষা দেওয়া হয়নি যে, পানি,
বিদ্যুৎ গ্যাস আমাদের জাতীয় সম্পদ; এর অপচয় রোধ করতে হবে। তাকে বলা হয়নি যে, এখনও আমাদের দেশের অনেক শিশু অনাহারে রাত কাটায়।
অতএব, কোনো ভাবেই খাদ্যের অপচয় করা যাবে না। তাদেরকে একথা অবশ্যই বুঝানো উচিৎ ছিল যে, একজন শিক্ষার্থীর অকৃত্রিম বন্ধু দুইজন- একজন
হলেন তার পিতা-মাতা এবং অন্যজন তার শিক্ষক। অতএব, তাদের সাথে সবসময় সুসম্পর্ক রাখবে। তাদেরকে এ কথা বুঝানো দরকার ছিলো যে, নারীরা
হলেন মায়ের জাতি। প্রতিটি মানুষের জন্ম কোনো না কোনো মায়ের গর্ভে। সুতরাং তাদেরকে সব সময়ে শ্রদ্ধার চোখে দেখতে হবে। কিন্তু এর কোনো কিছু
না করেই পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকেই ধ্বংসের পায়তারা করা হলো। এত বিশৃঙ্খলা আর হ য ব র ল অবস্থার মধ্যে শিক্ষা ব্যবস্থার কাফনের শেষ পেরেক
ঠোকা হলো এ বছর। বইয়ের পরতে পরতে ছড়িয়ে দেওয়া হলো ভুলে ভরা ইতিহাস, বিকৃত যৌনতা, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এবং ইসলাম ও মুসলমানদের
প্রতি কটাক্ষ করার প্রবণতা। এই ষড়যন্ত্রের সাথে যারা যুক্ত ছিলেন, আজ পর্যন্ত তাদের কোনো বিচার করতে না পারাটা জাতির জন্য সবচেয়ে বড় লজ্জা
আর কলঙ্কের।
উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রেও ভয়াবহ নৈরাজ এবং বিশৃঙ্খলা চোখে পড়ার মতো, এমন এমন বিষয় সেখানে চার থেকে ছয় বছরের পড়ানো হয় যে গুলো বাকি
জীবনে আর কোনো প্রয়োজনেই আসে না। তাহলে এই চার থেকে ছয় বছর কেন অর্থ, শ্রম এবং মেধার অপচয় করা হলো কেন? সে প্রশ্নের জবাব হয়তো
কেউ দিতে পারবে না। একজন শিক্ষার্থীকে ডাক্তার বানাতে জাতির চৌদ্দ থেকে ষোল লক্ষ টাকা খরচ হয়। সেই ডাক্তার যখন বিসিএস দিয়ে পুলিশ বা
প্রশাসনে যোগদান করে তখন সারাজীবনেও তার ডাক্তারি বিদ্যা আর কোনো কাজে আসে না। তাহলে এত অর্থের অপচয় করা কেন হল? শুরুতেই তো এ
নিয়ে ভাবার কথা ছিলো। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে না পারলে কোনো অবস্থাতেই জাতির মুক্তি নেই।
প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি মাদ্রাসা শিক্ষা এবং ইংরেজি শিক্ষার ফলে জাতি আজ ত্রিধারায় বিভক্ত। আমাদের সুস্পষ্ট প্রস্তাব যে, আমাদের শিক্ষা
ব্যবস্থা হবে বিজ্ঞান, বাস্তব এবং কর্মমুখী। প্রয়োজনে শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো তৈরি করে মেধাবীদের সেখানে আসতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থী একই প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করবে। এবং সকল ধরনের স্কুল ও মাদ্রাসায় একই সিলেবাস থাকবে।
বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কৃষি, কুরআন, হাদিস, নৈতিকতা, সুশাসন, দেশপ্রেম এই বিষয়গুলো পড়ানো হবে। অন্যান্য ধর্মের জন্য কুরআন
এবং হাদিসের পরিবর্তে তাদের ধর্মীয় বিষয় শিক্ষা প্রদান করা হবে। কোচিং এবং গাইড নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তে জীবনমুখী শিক্ষার ওপর গুরুত্ব
দিতে হবে। বাংলা, ইংরেজি এবং আরবিসহ তাকে একাধিক ভাষার দক্ষ করে তুলতে হবে। এইচএসসি পরীক্ষার পর একজন শিক্ষার্থী এক বছর দেশের
জন্য কাজ করবে। সেটা হতে পারে সেবামূলক বা উপার্জনমুখী। এর উপর নির্ভর করবে তার ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার।
এইচএসসি পাশের পর কোনো শিক্ষার্থীকে আর একাডেমিক পড়াশোনা করতে হবে না। তাকে যে সেক্টরে নিয়োগ প্রদান করা হবে, চার বছর পর সেই
সেক্টরই তাকে অনার্স ডিগ্রি প্রদান করবে। যেমনÑ কেউ ব্যাংকে নিয়োগ পেল, চার বছর পর তাকে ব্যাংকিং এর ওপর অনার্স ডিগ্রি প্রদান করা হবে।
পুলিশ, পররাষ্ট্র, কৃষি, চিকিৎসা, সেবা প্রতিটি সেক্টরেই অনুরূপভাবে শুরু থেকেই একজন শিক্ষার্থীকে নিয়োগ প্রদান করা হবে। তাতে শুরু থেকেই একজন
কর্মকর্তা বা কর্মচারী পুরোপুরি পেশাদারি হয়ে উঠবে। আর যারা কোথাও চান্স পাবে না, তারা যেকোনো সেক্টরে কাজে লেগে যাবে। এতে জাতির অর্থ,
মেধা এবং শ্রমের অপচয় রোধ হবে।
সবচেয়ে দুঃখজনক যে, একজন শিক্ষার্থী দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করার পরও বাংলা বর্ণমালার ৫০টি বর্ণ শুদ্ধ করে উচ্চারণ করতে পারে না;
ইংরেজিতে কথা বলতে পারে না। এ কারণে চাকরিতে প্রবেশের পূর্বে কোচিং এবং গাইডই হয়ে ওঠে তাদের একমাত্র ভরসাস্থল। এই কোচিং এবং গাইড
নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরে আসতে না পারলে কোনো অবস্থাতেই এ জাতির পক্ষে মুক্তির আলো দেখানো সম্ভব নয়। কোচিং এবং গাইড নির্ভরতা হবে
একজন শিক্ষার্থীর অযোগ্যতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ।