রাজনীতিতে মাৎসন্যায়! উত্তরণের সময় এখনই

জোর যার মুল্লুক তার)

জোর যার মুল্লুক তার)

“মাৎসন্যায়” (জোর যার মুল্লুক তার) এমন একটি ধারণা যেখানে শক্তিশালী ব্যক্তি বা বড় কোন গোষ্ঠী তুলনামূলক ছোট ও দুর্বলদের উপর প্রভুত্ব করে। ফলে আইনের শাসনের পরিবর্তে শক্তির দ্বারাই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। পুকুরের বড় ও সবল মাছগুলো যেমন ছোট ও দুর্বল মাছগুলোকে খেয়ে ফেলে ঠিক তেমনি রাজনীতিতে বড় দলগুলো ছোট দলগুলোকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে ও চাপে রাখে। টমাস হবস এর মতে, “মাৎসন্যায় এমন একটি প্রাকৃতিক অবস্থা, যেখানে নৈরাজ্য ও শক্তির ভারসাম্যহীনতা বিদ্যমান।”

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মতো বড় দলগুলোর একচ্ছত্র আধিপত্যের মধ্যে উদীয়মান রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য টিকে থাকা ও প্রভাব বিস্তার করা অত্যন্ত কঠিন। পতিত স্বৈরাচারী সরকার তাদের আমলে জাতীয় পার্টিকে একরকম নাকে রশি লাগিয়ে ঘুরিয়েছে। সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে বাঁচতে গিয়ে জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলীয় জোটের অনেক শরীককে নৈতিকতা, আদর্শ ও স্বত্তা বিসর্জন দিয়ে অনেকটা ‘সহমত পার্টি’ হিসেবে টিকে থাকতে হয়েছে। এটা প্রকৃত গণতন্ত্রের অন্তরায়। গণতন্ত্রে প্রত্যেক দলের কৌশলগত পরিকল্পনা, জনসমর্থন গঠন এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের নিজস্ব ফর্মুলা থাকবে। প্রত্যেক দলের এজেন্ডা হবে জণগণের ম্যানডেট নিয়ে কাজ করা। একাজে যে দল যত বেশি এগিয়ে থাকবে, জনগণ তাদেরকেই ভোট দিবে, জয়ী করবে। প্রকৃত গণতন্ত্রে কখনো আসন ভাগাভাগি হয় না। আসন ছাড় দেয়ার রাজনীতি গণতন্ত্রের সংজ্ঞাবিরুদ্ধ। 

জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে এর মধ্যেই অনেক নতুন দল আত্মপ্রকাশ করেছে। নতুন দলের কাছে গণতন্ত্রকামীদের প্রত্যাশা হচ্ছে বড় কোনও দলের রাজনৈতিক একঘেয়েমিকে আত্মস্থ না করা, জনগণের পালস বুঝা। বড় দলগুলোর সাথে জনস্বার্থবিরোধী যেকোন নেগোসিয়েশনে যাওয়া হতে পারি অদূরদর্শী ও আত্মঘাতী পদক্ষেপ। বাংলাদেশে চব্বিশ পরবর্তী প্রেক্ষাপট অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে ভিন্ন। ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ নিষিদ্ধ’- কথাটি আর ধোপে টিকছে না। সবাই এখন রাজনৈতিক আলাপ জরুরি মনে করছে। তাই নব্য দলগুলোকে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে হতে হবে দূরদর্শী ও দৃঢ়চেতা। নতুন দলগুলোর প্রতি সমসাময়িক কিছু প্রত্যাশা ও পরামর্শ তুলে ধরা হল-

১. জোট গঠন ও সমঝোতায় সতর্কতাঃ
বড় দলগুলোর বিরুদ্ধে এককভাবে লড়াই করা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। বিশেষ করে জাতীয় লক্ষ্যার্জনে বড় দলগুলো সহযোগিতা না করলে তাদের অনুসারী না হয়ে সমমনা ছোট দলগুলো মিলে জোট গঠন করে শক্তি বৃদ্ধি করা যেতে পারে।

২. নাগরিক ইস্যুতে সোচ্চার ভূমিকাঃ
ক্লিন ইমেজের দলগুলোর উচিৎ ‘ভোগান্তির রাজনীতি’ নিয়ে জণগণকে সচেতন করা। মূলধারার দলগুলোর ব্যর্থতা (যেমন: দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, দখলদারত্ব) ইত্যাদি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা।

৩. সাংগঠনিক শক্তি ও নেতৃত্বের বিকাশঃ
দলের ভেতর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু করে নেতৃত্বের রোটেশন নিশ্চিত করা যাতে দল একক নেতৃত্বের উপর অতিনির্ভরশীল না হয়ে পড়ে। তৃণমূল কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, যাতে তারা স্থানীয় পর্যায়ে দলের বার্তা পৌঁছাতে পারে। 

৪. স্থানীয় পর্যায়ে অবস্থান শক্ত করাঃ
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয় স্তরের চেয়ে স্থানীয় রাজনীতিতে নতুন দলগুলোর যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ বেশি। নতুন দলগুলো ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দলীয় কাঠামোকে শক্তিশালী করতে পারে।

৫. মডার্ণ ও প্রযুক্তিবান্ধব রাজনীতিঃ
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম বা সোশ্যাল মিডিয়া (ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম) ইত্যাদি ব্যবহার করে যুবসমাজকে সংগঠিত করা। তবে এক্ষেত্রে দলীয় আচরণবিধির ব্যাপারে নেতা-কর্মীদের সচেতন করা জরুরি। 

৬. আন্তর্জাতিক সমর্থন ও নেটওয়ার্কিংঃ
গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মানবাধিকার সংগঠন, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সাথে সংযোগ করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে জনসচেতনতা তৈরি করা। বাংলাদেশে রাজনৈতিক মাৎসন্যায় তথা বড় দলগুলোর অতিমাত্রায় প্রভাব বিস্তারের মূল কারণ হলো দুর্বল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ও জবাবদিহিতার অভাব। এহেন অবস্থার পরিবর্তনের জন্য ছোট দলগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তাদেরকে ধৈর্য্য, কৌশলগত চিন্তা এবং সংঘবদ্ধ থাকতে হবে। এর পাশাপাশি শক্তিশালী বিচারব্যবস্থা, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন তথা মৌলিক সংস্কারে নবীন ও ছোট দলগুলো সোচ্চার হতে পারলে সাফল্যের ইঙ্গিতটা সময়ই দিয়ে দিবে।।

নামঃ সাহেদ ইবনে বারী
পদবীঃ যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক
কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ পেশাজীবি অধিকার পরিষদ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top